জালেমের সামনে হক কথা সত্যের অনড় প্রতিধ্বনি

 

জালেমের সামনে হক কথা সত্যের অনড় প্রতিধ্বনি

জালেমের সামনে হক কথা সত্যের অনড় প্রতিধ্বনি
প্রতীকী ছবি

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার মূল ভিত্তি ন্যায়বিচার, ইনসাফ ও সত্যবাদিতা। ইসলামের অন্যতম শিক্ষা হলো—সত্যের পক্ষে অবিচল থাকা, অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। ইতিহাস সাক্ষী, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে জালিম শাসকের মুখোমুখি হয়ে সত্য উচ্চারণ করেছেন, তাঁদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত উঁচু।

সত্যের তাৎপর্য কোরআনের দৃষ্টিতে

আল্লাহ তাআলা কোরআনে সত্য বলার ওপর অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং মুমিনদের নির্দেশ দিয়েছেন সাহসের সঙ্গে সত্য উচ্চারণ করতে— ‘হে মুমিনরা! তোমরা সর্বদা আল্লাহর জন্য ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে সাক্ষ্য দাও, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বা পিতা-মাতার কিংবা আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়।

’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৩৫)

এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন যে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে হবে, তা যত কঠিনই হোক না কেন—যদি সেটা নিজের বিপক্ষেও যায়।

জালিম শাসকের সামনে সত্য বলা : শ্রেষ্ঠ জিহাদ

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সর্বোত্তম জিহাদ হলো জালিম শাসকের সামনে সত্য ও ন্যায়ের কথা বলা।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৩৪৪; তিরমিজি, হাদিস : ২১৭৪)

এই হাদিস ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এক বিপ্লবী বার্তা বহন করে। যখন অধিকাংশ মানুষ ভয়ে নীরব থাকে, তখন একজন ঈমানদার আল্লাহর ভয়ে জালিম শাসকের মুখোমুখি হয়ে সত্য বলার সাহস দেখায়।

ইসলাম এই কাজকে ‘সর্বোত্তম জিহাদ’ বলে আখ্যায়িত করেছে, যা একজন মুমিনের চরিত্রের চূড়ান্ত দৃঢ়তার প্রতীক।
সত্য বলার দায়িত্ব ও গুরুত্ব

ইসলামে সত্য বলা শুধু একটি চারিত্রিক গুণ নয়; বরং এটি একটি ফরজ দায়িত্ব। একাধিক হাদিসে রাসুল (সা.) মিথ্যার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এবং সত্যের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা সত্য বলো, কারণ সত্য সৎকর্মে নিয়ে যায়, আর সৎকর্ম জান্নাতে নিয়ে যায়।

’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

সত্য একজন মুসলিমের নৈতিক চেতনাকে গড়ে তোলে, যা তাঁকে অন্যায়, জুলুম থেকে দূরে রাখে।

জালিম শাসকের পরিচয় ও পরিণতি

কোরআনে বহু জালিম শাসকের উদাহরণ আছে—যেমন : ফিরাউন, নমরুদ, কারুন ইত্যাদি। তারা সবাই নিজেদের ইচ্ছাকে আল্লাহর আইনের ওপর স্থান দিয়েছিল, অন্যায়ভাবে মানুষকে শোষণ করেছিল। কিন্তু আল্লাহ তাদের কাউকেই রক্ষা করেননি।

ফিরাউনের ঘটনা : আল্লাহ বলেন, ‘আখেরে আমি তাকে এবং তার সৈন্যবাহিনীকে সমুদ্রের মাঝে নিমজ্জিত করলাম, অথচ তারা ছিল জালিম।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৪০)

এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ফিরাউন ধ্বংস হয়েছে, কারণ সে জালিম ছিল। আর জুলুমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো—সত্য।

ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর ইতিহাস

ইসলামের ইতিহাসে বহু নবী, সাহাবি ও মনীষীরা জালিম শাসকদের মুখোমুখি হয়ে সত্য বলেছেন।

এক. মুসা (আ.) ও ফিরাউন : মুসা (আ.)-এর কাহিনি কোরআনে বহুবার এসেছে। তিনি নির্ভীকভাবে ফিরাউনের দরবারে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি তোমার কাছে এসেছি, যেন তুমি বনি ইসরাঈলকে আমার সঙ্গে যেতে দাও।’ [সুরা : শোয়ারা : ১৬-১৭]

দুই. হুসাইন (রা.) : ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হলো কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত। তিনি ইয়াজিদের অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্য ও ইনসাফের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন।

কেন মানুষ সত্য বলতে ভয় পায়?

এক. জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভয়

দুই. সম্পদ হারানোর আশঙ্কা

তিন. সমাজ বা শাসকের প্রতিশোধের আশঙ্কা

চার. পদ বা প্রভাব হারানোর ভয়

কিন্তু একজন ঈমানদার সব ভয় ত্যাগ করে আল্লাহর ওপর ভরসা করে সত্য বলবে। কারণ আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন।’  (সুরা : তালাক, আয়াত : ২)

সত্য উচ্চারণের ফলাফল

যদিও দুনিয়াবি দৃষ্টিতে সত্য বলার পরিণতি কখনো কখনো কঠিন হতে পারে [বহিষ্কার, জেল, নির্যাতন], কিন্তু আল্লাহর কাছে এটি মহা প্রতিদানযোগ্য কাজ। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘লোকেরা যখন কোনো অন্যায় দেখে এবং তাকে প্রতিহত করে না, তখন অচিরেই আল্লাহ তাদের সবাইকে শাস্তি দিতে পারেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২১৬৮)

এখানে বোঝানো হয়েছে, সমাজে জুলুম চললেও যদি কেউ প্রতিবাদ না করে, তবে সবাই আল্লাহর গজবে পড়তে পারে। তাই সত্য বলা শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়, এটি সামাজিক ও দ্বিনি কর্তব্য।

সমসাময়িক প্রেক্ষাপট

আজকের সমাজেও বহু শাসক অন্যায়ভাবে শাসন করছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন, দুর্নীতি করছেন এবং জনগণের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছেন। যারা এসব শাসকদের সমর্থন করে বা নীরব থাকে, তারাও এই অন্যায়ে অংশীদার হয়ে যায়। কিন্তু কিছু মানুষ এখনো সাহস করে এই জালিমদের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে, যেমন : সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আলেমসমাজ—এরা হলেন সত্য ও ইনসাফের আধুনিক সৈনিক।

আমাদের করণীয়

এক. আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে সত্য বলা।

দুই. জালিম শাসকের বিরুদ্ধে ন্যায়ের আওয়াজ তোলা।

তিন. মুসলিম উম্মাহকে সচেতন ও সংগঠিত করা।

চার. দোয়া করা যেন আল্লাহ সাহস ও হিদায়াত দান করেন।

পাঁচ. সাহসী ও সৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলা।

সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা

জালিম শাসকের সামনে সত্য বলা ইসলামে শুধু একটি চারিত্রিক গুণ নয়; বরং এটি ঈমানের পরিচয়। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং সত্যের কথা বলে, তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ প্রতিদান ও মর্যাদা রয়েছে। ইসলাম এমন একটি দ্বিন, যা অন্যায়কে কখনো মেনে নেয় না; বরং তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত, অন্তত নিজেদের পরিসরে হলেও সত্য বলার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা।

লেখক : মুহতামিম, জহিরুল উলুম মহিলা মাদরাসা, গাজীপুর

https://www.profitableratecpm.com/jwiigxt9di?key=e6b399d558992f12dcf68d25b5f7e584

Post a Comment

Previous Post Next Post