হিলফুল ফুযুল ও মহানবী (সা.)-এর সংগ্রামী যৌবন

 

হিলফুল ফুযুল ও মহানবী (সা.)-এর সংগ্রামী যৌবনহিলফুল ফুযুল ও মহানবী (সা.)-এর সংগ্রামী যৌবন

প্রতীকী ছবি   

ফিজার যুদ্ধ আরব সমাজের বুক চিরে দিয়ে গিয়েছিল অশেষ দুঃখ ও শোকের দাগ। কত প্রাণ ঝরে গেলো, কত শিশু হয়ে গেল ইয়াতীম, কত নারী বিধবা হলো—তার কোনো হিসাব নেই। শহরের বাজার ও মরুভূমির পথগুলোতে ছড়িয়ে ছিল শুধু ক্রন্দন আর রক্তের দাগ। আরবের চিন্তাশীল ও ন্যায়পরায়ণ মানুষরা তখন গভীর বেদনায় উপলব্ধি করলেন যে, এই অকারণ যুদ্ধ আর চলতে দেওয়া যায় না।

মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে কিছু মৌলিক অঙ্গীকার প্রয়োজন।

এই উপলব্ধি থেকেই মক্কার প্রভাবশালী নেতা ও দানশীল ব্যক্তি  আব্দুল্লাহ বিন জুদ‘আন তাইমির গৃহে এক ঐতিহাসিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বনু হাশিম, বনু মুত্তালিব, বনু আসাদ, বনু যুহরা ও বনু তামীমসহ কয়েকটি প্রভাবশালী গোত্রের প্রতিনিধিরা। তখনকার সময়ে নিয়ম ছিল গোত্রীয় কিংবা বংশীয় কোনো ব্যক্তি, আত্মীয়-স্বজন অথবা সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ কোনো ব্যক্তি শত অন্যায়-অনাচার করলেও সংশ্লি¬ষ্ট সকলকে তাঁর সমর্থন করতেই হবে তা সে যত বড় বা বীভৎস অন্যায় হোক না কেন।

 এরই প্রেক্ষিতে সমাজে অনাচার বৃদ্ধি পাওয়ায সকল গোত্রপতিাগণ  দীর্ঘ আলোচনার পর সবাই একমত হলেন যে, গোত্রীয় অহংকার বা আত্মীয়তার অজুহাতে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। বরং তারা প্রতিজ্ঞা করলেন—

•    দেশের অশান্তি দূর করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে,
•    বিদেশি বণিক ও যাত্রীদের ধন-প্রাণ ও সম্মান রক্ষা করা হবে,
•    অসহায় ও দুর্বল মানুষকে সাহায্যে এগিয়ে আসতে কোনো দ্বিধা থাকবে না,
•    আর অন্যায়-অত্যাচারীর হাত থেকে নিরপরাধ মানুষকে রক্ষায় প্রাণপণ সংগ্রাম চালানো হবে।

ন্যায় ও মানবতার পক্ষে এই চুক্তি ইতিহাসে “হিলফুল ফুযূল” বা “হলফ-উল ফুযূল” নামে খ্যাতি পায়। মহানবী (সা.) এ চুক্তির অংশ ছিলেন এবং বহু বছর পরে এর কথা স্মরণ করে দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন—আজও যদি কোনো অত্যাচারিত মানুষ এই অঙ্গীকারের আহ্বান জানায়, তিনি অবশ্যই সাড়া দেবেন।

এছাড়াও তিনি এই চুক্তি স্মরণ করে বলেছিলে যে, “‘আব্দুল্লাহ বিন জুদ’আনের বাসভবনে আমি এমন এক অঙ্গীকারনামায় শরীক ছিলাম যার বিনিময়ে আমি আসন্ন প্রসবা উটও পছন্দ করি না এবং যদি ইসলামের যুগে এরূপ অঙ্গীকারের জন্য আমাকে আহবান জানানো হয় তাহলেও ‘আমি উপস্থিত আছি কিংবা প্রস্তুত আছি’ বলতাম।”

হিলফুল ফুযূল গঠনের পেছনে এক হৃদয়বিদারক ঘটনাও ছিল। জুবাইদ নামে এক ব্যবসায়ী মক্কায় এসে মাল বিক্রি করেছিলেন। ধনাঢ্য আস বিন ওয়ায়িল তাঁর মাল নিয়ে গেলেও প্রাপ্য অর্থ ফিরিয়ে দিল না। অবহেলিত জুবাইদ ন্যায় বিচারের আশায় বিভিন্ন গোত্রের দ্বারে দ্বারে গেলেন, কিন্তু কেউ তার পাশে দাঁড়াল না।

https://www.profitableratecpm.com/jwiigxt9di?key=e6b399d558992f12dcf68d25b5f7e584
শেষমেশ তিনি আবূ কুবাইশ পাহাড়ের চূড়ায় উঠে উচ্চকণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করলেন—নিজের অসহায় অবস্থার করুণ বর্ণনা দিলেন। তাঁর এ আর্তি শুনে জুবাইর ইবন আব্দুল মুত্তালিব ছুটে গেলেন এবং অন্য গোত্রদের সঙ্গে নিয়ে এক ন্যায়নিষ্ঠ চুক্তি সম্পাদন করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় জুবাইদের পাওনা আদায় করে দেওয়া হয়।

অন্যদিকে, মুহাম্মাদ (সা.)-এর শৈশব ও কৈশোর ছিল কঠোর পরিশ্রম ও দুঃখময় সংগ্রামের। বনু সা‘দ গোত্রে পালিত অবস্থায় তিনি ছাগল চরাতেন। মক্কায় ফিরে এসেও সামান্য পারিশ্রমিকে ছাগল চরাতেন। কৈশোরে চাচা আবূ ত্বালীবের সঙ্গে সিরিয়া গমন করেছিলেন বাণিজ্যের কাজে। তখন থেকেই সততা, আমানতদারিত্ব ও সৌজন্যের জন্য ব্যবসায়ী মহলে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। একসময় খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ তাঁর সততা ও চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে প্রস্তাব দিলেন—তিনি যেন তাঁর পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করেন। মুহাম্মাদ (সা.) এ প্রস্তাবে সম্মত হন এবং খাদীজার দাস মায়সারাকে সঙ্গে নিয়ে শাম দেশে পাড়ি জমান। এ সফরে তিনি শুধু ব্যবসায়িক সফলতাই অর্জন করেননি, বরং তাঁর ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল দ্যুতি সবার সামনে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

হিলফুল ফুযূলের অঙ্গীকার আর মুহাম্মাদ (সা.) এর শ্রমনিষ্ঠ যৌবন মিলেমিশে যেন ইতিহাসের এক অনন্য পাঠ হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে আছে ন্যায় প্রতিষ্ঠার শপথ, মানবিকতার সুরক্ষা এবং অবিচল সংগ্রামের বার্তা—যা তাঁর নবুওতের জীবনেরও ভিত্তি হয়ে উঠেছিল।

(আর রাহীকুল মাখতুম অবলম্বনে)
-[চলবে... ইনশাআল্লাহ]

Post a Comment

Previous Post Next Post